একদিন আরাফাতকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সাধারণভাবে দেখলে তো আপনাকে আয়রনম্যান মনে হয় না।’ কারণ, আয়রনম্যান শব্দটিতে একটি কাঠিন্য বিরাজ করে, পেশিবহুল শারীরিক কাঠামো ও শক্তিমত্তার কথাও মনে চলে আসে। উত্তরে আরাফাত বললেন, ‘আমি সেটা বোঝাতেও চাই না। আমাকে দেখে মানুষ আয়রনম্যান ভাবুক, সেটা চাই না।’
মোহাম্মদ শামছুজ্জামান আরাফাত না চাইলেও আয়রনম্যান। সাঁতার, সাইক্লিং আর দৌড় মিলিয়ে যে ক্রীড়া, সেটা ট্রায়াথলন। ট্রায়াথলনের কঠিনতম চ্যালেঞ্জ হলো আয়রনম্যান প্রতিযোগিতা। এশিয়া, ইউরোপের কয়েকটি আয়োজনে আয়রনম্যান খেতাব পেয়ে গত সেপ্টেম্বরে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত আয়রনম্যান ৭০.৩ ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়ে চ্যালেঞ্জ পূর্ণ করেন সফলভাবেই। প্রথম আলোর ২৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর তথ্যচিত্র আয়রনম্যান আরাফাত তাঁকে নিয়ে।
বায়ু দূষণ, র্বতমান সময়রে অন্যতম বড় সমস্যা। ক্রমইে দূষতি বায়ুতে ভরে যাচ্ছে আমাদরে পৃথবিী। বাড়ছে শ্বাস-প্রশ্বাসরে সমস্যা। এমনকি ছোট বাচ্চাদরে মধ্যওে নশ্বিাসরে কষ্ট এখন প্রায়ই দখো যায়। নিয়মিত যোগাভ্যাস কন্তিু আপনাকে এই সমস্যা থকেে মুক্তি দতিে পার। ভাবছেন, যোগ ব্যায়ামরে সঙ্গে শ্বাসকষ্টরে কী সর্ম্পক? সর্ম্পক আছ। নির্দিষ্ট কয়েকটি আসন নয়িমতি ভাবে অভ্যাস করলে শ্বাসকষ্ট আপনার ধারে কাছেও ঘেষতে পারবে না। এক ঝলকে সেই আসনগুলি জনেে নেওয়া যাক।
অনুলোম-বিলোম:
যেকোনও যোগা সেশন শুরু করুন আনুলোম-বিলোম দিয়ে। যোগাভ্যাসের ফল আরও ভালো ভাবে পাবেন আপনি। এই প্রাণায়াম আমাদের দৈহিক শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে, অ্যাজমার সমস্যাকে দূরে সরায়। এছাড়া নিয়মিত অনুলোম-বিলোম করলে তা শরীরকে ঠাণ্ডা করে, হৃদযন্ত্রের সমস্যা মেটায় ও মনঃসংযোগ বাড়াতে সাহায্য করে। শ্বাসকষ্ট ও স্নায়ুর সমস্যায় ভুগছেন যারা, তাঁদের জন্য অনুলোম-বিলোম খুবই দরকারি।
পদ্ধতি
যোগা ম্যাটে পদ্মাসনে বসুন। শিরদাঁড়া সোজা রাখুন। এবার ডান হাতের তর্জনী দিয়ে বাঁ নাক চেপে ধরে ডান নাক দিয়ে জোরে শ্বাস নিন। ৫-১০ সেকেন্ড শ্বাস ধরে রেখে বুড়ো আঙুল দিয়ে ডান নাক চেপে বাঁ নাক দিয়ে নিশ্বাস ছাড়ুন। এরকম ভাবে দুই দিকের নাক দিয়েই ১০ বার করে করুন।
উত্তনাসন:
অ্যাজমার সমস্যা সমাধানে উত্তনাসন খুবই প্রয়োজনীয় একটি আসন। এ ছাড়াও কোষ্ঠকাঠিন্য সহ পেটের নানা সমস্যা দূর করে উত্তনাসন। এছাড়াও ইনসমনিয়া ও মেনোপজের পর মহিলাদের নানা সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে উত্তনাসন। নিয়মিত উত্তনাসন অভ্যাস করলে তা মানসিক চাপ কমিয়ে হতাশা দূর করতে সাহায্য করে। নার্ভের সমস্যা, কিডনি, লিভারও ভালো রাখে উত্তনাসন।
পদ্ধতি
যোগা ম্যাটে সোজা হয়ে দাঁড়ান। দুটি পায়ের মধ্যে এক ইঞ্চির মতো ফাঁক রাখুন। হাঁটু না ভেঙে কোমর থেকে গোটা শরীরকে নিচে ঝুঁকিয়ে দিন। দুটো হাঁটুকে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরতে পারবেন, এরকম ভাবে শরীরটাকে নিচে ঝুঁকিয়ে দিন। হ্যামস্ট্রিং-য়ে টান না লাগা পর্যন্ত এ ভাবেই থাকুন।
শবাসন:
সব যোগা সেশন শেষ হয় শবাসনের মাধ্যমে। যোগাভ্যাস করার সময় শরীর যে স্ট্যামিনা ক্ষয় করে, তা আবার পুনরুজ্জীবিত হয় শবাসনের মাধ্যমে। এর নানা উপকারিতা আছে। তার মধ্যে একটি হল শ্বাসকষ্ট দূর করা। এছাড়াও বদহজম ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। মানসিক উদ্বেগ কাটিয়ে রক্তচাপ স্বাভাবিক করতে সাহায্য করে শবাসন। নার্ভের সমস্যার স্বাভাবিক করে নিয়মিত শবাসন অভ্যাস।
পদ্ধতি
আপনার যোগা ম্যাটে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ুন। সারা শরীরকে আলগা করে দিন। পা দুটো সোজা ও দুই হাত শরীরের সঙ্গে লম্বা করে রাখুন। যেন মনে হয় আপনার শরীরে কোনও প্রাণ নেই। হাতের তালু দুটো সিলিং-এর দিকে মুখ করে রাখুন। এই অবস্থায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে নিজের শ্বাস-প্রশ্বাস গোনার চেষ্টা করুন। এভাবে ১০ থেকে ১৫ মিনিট থাকুন। শবাসনের অবস্থায় থাকার সময় মেডিটেশন করুন।
ডিপ্রেশন এনজাইটি রোগীদের ওষুধের পাশাপাশি নিয়মিত শরীরচর্চা বা হাঁটতে হবে। আমি প্রায়শই এ পরামর্শ দিয়ে থাকি। হাঁটলে ব্রেইনের কোষ থেকে কিছু নিউরোট্রান্সমিটার নিঃসৃত হয় যা প্রাকৃতিক ভাবেই ডিপ্রেশন কাটাতে সহায়ক।
কাজকর্মের ব্যস্ততায় আমরা অনেক সময় হাঁটতে পারি না। তবে কিছু কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করলে খুব সহজেই আমাদের হাঁটা হয়ে যায়। যেমন-
১. বাচ্চাদের স্কুলে পৌঁছে দিতে তার সাথে হাঁটুন এবং গল্প করুন। এতে দু'জনের লাভ। আপনার সন্তানকে আপনি একটা ভালো অভ্যাস করাচ্ছেন এবং তার সাথে ঘনিষ্ঠ সময় কাটাচ্ছেন। আর এ মূহুর্তের কথা দুজনের আজীবন মনে থাকবে। কিন্তু গাড়িতে বা বাহনে গেলে আপনার বা আপনার সন্তানের হাতে থাকবে মোবাইল বা ট্যাব।
২. অফিস থেকে গন্তব্যে যেতে দু’একটা স্টেশন আগে নামুন। নেমে আপনার গন্তব্যে বা আবাসস্থলে যান। তখন বাসায় গেলে মনটা ফ্রেশ হয়ে যাবে। ঝগড়াঝাটির সম্ভাবনা কমে যাবে। শরীরে উদ্যম পাবেন। আর পাবলিক ট্রান্সপোর্ট হলে দুটোপয়সাও সেভ হবে যা দিয়ে মাস শেষে আপনি সুন্দর কিছু একটা কিনতে পারবেন।
৩. অফিস আদালতে লিফট এলিভেটর ব্যবহার না করে অবশ্যই সিঁড়ি ব্যবহার করবেন। এতে এক সময় সিঁড়ি ব্যবহার অভ্যাস হয়ে যাবে। আপনার ফিগার টাও চমৎকার একটা শেইপে চলে আসবে।
৪. আপনার ব্যক্তিগত গাড়ি হলে সেটা পার্ক করবেন একটু দূরের পার্কিংয়ে। তাতে গাড়িতে উঠতে ও নেমে অফিসে যেতে আপনার খানিকটা হাঁটা হয়ে যাবে। শরীরটাও ঝরঝরে হয়ে যাবে অজান্তেই।
৫. লাঞ্চ করতে বা ব্রেকফাস্ট করতে একটু দুরের রেস্ট্রুরেন্ট চয়েস করবেন এবং হেঁটে যাবেন। এতে খাবারের আগে ও পরে হাঁটার কাজটা হয়ে যাবে। খাবার ডাইজেস্ট ও ভালো হবে।
৬. রাতে খাবারের পর একটু হাঁটবেন অথবা রাতে এশার নামাজ রাতের খাবারের পর রুটিনে রাখবেন। তাতে শরীর চর্চার ও সাইকোথেরাপি দুটোই হয়ে যাবে। নামাজের মাধ্যমে খুব ভালো সাইকোথেরাপি হয়।
ফিট থাকা তো বটেই, চাইলে লম্বা দৌড়, সাইক্লিং, সাঁতার সবই সম্ভব সবার পক্ষে। আরাফাত শোনালেন সেই ফর্মুলা—‘ওয়াক-জগ-রান’। ধরুন প্রথম দিন ৩ মিনিট হাঁটলেন, ২ মিনিট জগিং আর ১ মিনিট দৌড়ালেন। এরপর ধীরে ধীরে সময়টা বাড়িয়ে নিলেন।
আরাফাত বললেন, ‘ধীরে ধীরে সময় বাড়ালে ২১ দিনেই ব্যায়াম বা শরীরচর্চাকে ভালো বেসে ফেলবেন।’ ২১ দিন কেন? ‘বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত টানা ২১ দিন কোনো কিছু করলে সেটা অভ্যাসে পরিণত হয়। পুরোনো অভ্যাস বদলে যায়।’ বললেন আয়রনম্যান।
সবশেষে আরাফাত শোনালেন সেই চিরায়ত সত্য, শরীর ফিট রাখতে জীবনযাপনে শৃঙ্খলার বিকল্প নেই।
আরাফাত নিয়মিত ব্যায়াম করেন খালি হাতে।
আরাফাতের সাপ্তাহিক রুটিনটা এমন—
-
২ দিন খালি হাতে স্ট্রেংথ ট্রেনিং।
-
২ দিন কোর ওয়ার্কআউট। এই ব্যায়াম করেন পেট থেকে কোমর পর্যন্ত।
-
২ দিন হিট ট্রেনিং। হিটের পূর্ণ রূপ হাই-ইনটেনসিটি ইন্টারভ্যাল ট্রেনিং। এটি হলো পুরো শরীরে ব্যায়াম। ব্যায়ামের রুটিনে ১ দিন যোগব্যায়াম থাকে আরাফাতের।
-
১ দিন পুরো বিশ্রাম। আরাফাতের ভাষায় বিশ্রাম মানে সত্যিকারের বিশ্রাম।
-
এর বাইরে সপ্তাহে ৩ দিন সাঁতার কাটেন আরাফাত।
-
আরাফাত বললেন, ‘আমি যেহেতু ট্রায়াথলন করি, তাই সাঁতার, দৌড় আর সাইক্লিং চর্চা করি জীবনযাপনের অংশ হিসেবেই। কোনো ইভেন্টের আগে সপ্তাহে ৪ বার সাইক্লিং, ৫ বার দৌড় চর্চা করি।’ প্রতিযোগিতায় যে দূরত্ব পেরোতে হবে, সেই দূরত্বই থাকে চর্চায়।
কয়েক দিন আগে এক সন্ধ্যায় নিজের বাসা পলাশী থেকে আরাফাত এলেন কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো অফিসে। হালকা হাঁপাচ্ছিলেন। জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতে আরাফাত বললেন, ‘বিকালে দৌড়াচ্ছিলাম। ভাবলাম আবার পোশাক বদলে আসতে সময় লাগবে বেশি। আর রাস্তাতেও অনেক জ্যাম। তাই দৌড়ে এলাম।’ টেকনাফ থেকে বাংলাবান্ধা ১,০০৪ কিলোমিটার দৌড়ানোর অভিজ্ঞতা যার, সেই আয়রনম্যানের জন্য এই দূরত্ব তো নস্যি!
আরাফাত বাংলাদেশ ব্যাংকের উপপরিচালক। অফিসে প্রতিদিন যাতায়াত করেন সাইকেলে। বললেন, ‘ঢাকায় মোটামুটি সাইকেলে যাই সব জায়গায়। শ্বশুরবাড়ি কিশোরগঞ্জেও সাধারণত সাইকেলে যাওয়া হয়।’ আর করোনার সময় নোয়াখালীর নিজ বাড়িতেও ঢাকা থেকে সাইকেলে গিয়েছেন আরাফাত। আর সবকিছুর পরে সপ্তাহে এক দিন ১০০ থেকে ২০০ কিলোমিটার সাইকেল চালান আরাফাত।
ট্রায়াথলনে তিনটি খেলার সমন্বয় ঘটে। আরাফাত যোগ করলেন, ‘ট্রায়াথলনের চতুর্থ অংশ হলো পুষ্টি। এটা আমি নিশ্চিত করি পরিকল্পনা ভিত্তি করে।’